চলছে বিশ্বের সবচেয়ে জমজমাট টি২০ ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লীগ আইপিএলের ১৭তম আসর। ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে টুর্নামেন্টের ৪৩টি ম্যাচ। ৭৪ ম্যাচের টুর্নামেন্টের মাঝপথে এসে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো এবারের আসরের রান উৎসব! বোলারদের কাঁদিয়ে ইনিংসে অহরহ হচ্ছে ২০০+ রান। এত রানও জয়ের জন্য যথেষ্ট মনে হচ্ছে না; দুইশর বেশি রান তাড়া করেও বেশ কয়েকটি ম্যাচ জিতেছে পড়ে ব্যাট করা দল।
এবারের আসরে এখন পর্যন্ত মোট ২৬ ইনিংসে দুইশর বেশি স্কোর হয়েছে যা গত আসরের চেয়ে ১১ বার কম। ১৯০ থেকে ১৯৯ রান হয়েছে মোট ১০ বার। যেভাবে অহরহ ২০০+ রান হচ্ছে গতবারের রেকর্ডটি টিকবে না তা সহজেই অনুমান করা যায়! আইপিএলে লাগামহীন রান উৎসব শুরু হয়েছে মূলত গত আসর থেকে। ২০২৩ আসরে মোট ৩৭টি ইনিংসে দুইশর বেশি রান হয়েছিল। গত আসরের আগে ২০২২ সালে ২০০+ স্কোর হয়েছিল মোট ১৭ বার। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ১৫। শুধু ২০০ রান করেই থামছে না ইনিংস; ২২০+ রান হয়েছে ১৭ বার যার মধ্যে ৭টি ইনিংস চলে গেছে ২৫০ এর উপরে! ২০০ রান তাড়া করে ৪টি ম্যাচ জিতেছে পরে ব্যাট করা দল। গতকাল ৪২তম ম্যাচে কলকাতার দেয়া ২৬১ রানের লক্ষ্য তাড়া করে ৭ বল হাতে রেখেই জয় পেয়েছে পাঞ্জাব কিংস যেটা আইপিএল ইতিহাসে সবচেয়ে বড় লক্ষ্য তাড়া করে জয়ের রেকর্ড।
এ বছর বড় রান সংগ্রহ করায় সবচেয়ে এগিয়ে সান রাইজার্স হায়দ্রাবাদ ও কলকাতা নাইট রাইডার্স । তারা মোট ৪ ম্যাচে দুইশর বেশি স্কোর করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া তিনটি করে ম্যাচে দুইশর বেশি রান করেছে চেন্নাই সুপার কিংস, রয়েল চ্যালেন্জার্স বেঙ্গালুরু, মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স ও দিল্লি ক্যাপিটাল। এক ইনিংসে ২৮৭ রান করে আইপিএলের সর্বোচ্চ দলীয় রানের রেকর্ড এখন সানরাইজার্স হায়দ্রবাদের দখলে। ৩০তম ম্যাচে রয়েল চ্যালেন্জার্স বেঙ্গালুরুর বিপক্ষে তাদের সংগৃহীত ২৮৭ রানের জবাবে বেঙ্গালুরু সংগ্রহ করেন ২৬২ রান। দুই ইনিংস মিলিয়ে এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডও এই ম্যাচটি। এই ম্যাচ ছাড়াও সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ এবারের আসরে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিপক্ষে ২৭৭ রান এবং দিল্লি ক্যাপিটালসের বিপক্ষে ২৬৬ রান করেছেন। ২৫০+ স্কোর করা বাকি দলগুলোর নাম কলকাতা নাইট রাইডার্স, রয়েল চ্যালেন্জার্স বেঙ্গালুরু, পাঞ্জাব কিংস ও দিল্লি ক্যাপিটালস।
আইপিএলে যেভাবে রান উৎসব চলছে তাতে যে কোন সময় ইনিংসে ৩০০ রানের রেকর্ড হয়ে যেতে পারে। ৩৫তম ম্যাচে দিল্লির বিপক্ষে হায়দ্রাবাদের ব্যাটিং দেখে সেরকমই মনে হচ্ছিল। পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে ট্রেভিস হেড ও অভিষেক শর্মা মিলে ১২৫ রান তোলার পর মনে হচ্ছিল আজ বুঝি ৩০০ রান হয়েই যাবে। হেড ৩২ বলে ৮৯ আর অভিষেক ১২ বলে ৪৬ রান করে আউট হওয়ার পর তা আর হয়ে উঠেনি! ইনিংস শেষ হয়েছিল ২৬৬ রানে।
আইপিএলে এত রান হওয়ার কারণ কি?
ক্রিকেটে টি২০ সংস্করণ চালু করা হয়েছিল স্বল্প সময়ের ম্যাচে চার/ছক্কার প্রদর্শনীর মাধ্যমে দর্শকদের বিনোদন দেবার পাশাপাশি ক্রিকেটকে পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্য নিয়ে। টেস্ট ম্যাচ ও ওয়ানডে ম্যাচে লম্বা সময় স্টেডিয়াম বা টিভি সেটের সামনে বসে থাকা অনেকের কাছেই বিরক্তিকর। তবে তিন ঘণ্টার টানটান উত্তেজনার ম্যাচে আগ্রহ আছে অনেকেরই। টি২০ ক্রিকেটের নিয়মকানুনও এমনভাবে করা যাতে ব্যাটসম্যানরা রান করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুবিধা পায়।
আইপিএলে দর্শক-সমর্থক, ফ্র্যাঞ্চাইজি ও স্পন্সরদের কথা মাথায় রেখে ম্যাচ যাতে হাই স্কোরিং হয় সেভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে এটাই স্বাভাবিক! লো-স্কোরিং ম্যাচে উত্তেজনা কম থাকে, দর্শকরা বিনোদন পায় কম। এখানে ব্যবসার বিষয়টিও জড়িত। ম্যাচে যত রান হবে দর্শকরা তত বেশি বিনোদন পাবে, টিকেট কেটে মাঠে আসবে। এতে আইসিসি, ক্রিকেট বোর্ড ও দর্শক সকলেরই লাভ! তাই তো আইপিএলের পিচগুলো হয় শক্ত, ফ্ল্যাট ও ব্যাটিং সহায়ক। ফাস্ট আউটফিল্ড আর ছোট বাউন্ডারি ব্যাটসম্যানদের উৎসাহ দেয় হাত খুলে মারার! এছাড়া এবার আইপিএলে বেশি রান হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো "ইম্প্যাক্ট খেলোয়াড়"। ইম্প্যাক্ট খেলোয়াড় অন্তর্ভুক্তিতে ব্যাটিংয়ে একজন বেশি ব্যাটসম্যান ব্যাট করার সুযোগ পাচ্ছে। অর্থাৎ একজন বোলারের পরিবর্তে একজন ব্যাটসম্যান ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাচ্ছেন! যদি এই নিয়ম নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে কিন্তু পক্ষেও মতামত দিয়েছে ক্রিকেট বোদ্ধারা।
আইপিএলে এত এত রান হওয়া নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে অনেক। খোদ ভারতীয় প্রাক্তন ক্রিকেটাররাও অনেকে নিয়ম কানুন বদলানোর পরামর্শ দিয়েছেন। সুনীল গাভাস্কার এত রান যাতে না হয় এজন্য বাউন্ডারি আরো দুই/তিন মিটার বড় করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, "নেটে কোচরা ব্যাটসম্যানদের দিয়ে ইচ্ছেমতো উইকেটের চারদিকে ব্যাটিং করাচ্ছেন; এটা দেখতে ভাল লাগলেও একটা সময় তা বিরক্তিতে পরিণত হবে।"
তবে আইপিএলের মত আন্তর্জাতিক টি২০ ম্যাচগুলোতেও এভাবে রান হবে সেটা মনে করার কারণ নেই। এ বছর জুনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হবে টি২০ বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দল ও আইপিএলে দিল্লি ক্যাপিটালসের প্লেয়ার ডেভিড ওয়ার্নার সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎকারে বলেন' " টি২০ বিশ্বকাপে আইপিলের মত এত রান হবে না। সেখানকার পিচগুলো ধীরগতির হয়ে থাকে, উইকেটে কিছুটা টার্নও থাকে। উইকেট কিছুটা নীচু ও ধীরগতির হয়।"
0 মন্তব্যসমূহ