ক্রিকেটে স্যার (Sir) উপাধি নিয়ে ত্রিকেট প্রেমিদের মনে প্রশ্নের শেষ নেই! কাদের স্যার উপাধি দেয়া হয়? স্যার উপাধি পাওয়ার যোগ্যতা কি? কে বা কারা স্যার উপাধি দেয়? শচীন টেন্ডুলকার, কপিল দেব, ইমরান খান বা মুতিয়া মুরালিধরনরা কেন স্যার উপাধি পায় না ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন! অনেকেই মনে করেন কিংবদন্তি ক্রিকেটাররাই বুঝি স্যার উপাধি পেয়ে থাকেন! বিষয়টা আসলে সেরকম না। এই আর্টিকেলে Knighthood এ্যাওয়ার্ড বা স্যার উপাধি নিয়ে বিস্তারিত বোঝার চেষ্টা করবো!
Knighthood এ্যাওয়ার্ড বা Knight ও Dame উপাধির ইতিহাস:
ক্রিকেটে স্যার উপাধি বা নাইটহুড এ্যাওয়ার্ড কাদের দেয়া হয় সেটা জনার আগে নাইটহুড এ্যাওয়ার্ড কি সেটা জানা জরুরী। নাইটহুড এ্যাওয়ার্ড যুক্তরাজ্যের রাজ পরিবার প্রদত্ত সর্বোচ্চ সম্মাননা পুরষ্কার। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, খেলাধুলা সহ বিভিন্ন বিভাগে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অসামান্য অবদান রাখা ব্যাক্তিদের ব্রিটিশ রাজ পরিবারের মাধ্যমে রাজকীয আয়োজনের মাধ্যমে রাজা বা রানী নিজে উপস্থিত থেকে এই পুরষ্কার প্রদান করে থাকেন। রাজা বা রানীর সামনে হাটু গেড়ে বসে এই সম্মাননা পুরষ্কার গ্রহন করতে হয়। রাজা বা রানী পুরষ্কারপ্রাপ্ত ব্যাক্তির কাধে তরোয়ার স্পর্শ করার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা করেন। তবে কমনওয়েলথভুক্ত দেশের নাগরিকরা সবসময় রাজা বা রানির কাছ থেকে এই সম্মাননা নেয়ার সুযোগ পায় না। তাদেরকে নিজ দেশে রাষ্ট্রীয় পদ্ধতিতে মেডেল ও সনদ নিতে হয়। নাইটহুড এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত পুরুষদের "নাইট" বা স্যার (Sir) এবং নারীদের ডেম (Dame) বলে সম্মান জানানো হয়।নাইটহুড এ্যাওয়ার্ডের ইতিহাস খুব পুরোনো। অতীতে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীতে অসামান্য সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্য এই সম্মান পুরষ্কার প্রদান করা হতো। ধারনা করা হয় মধ্যযুগে রোমান সাম্রাজ্য ও খ্রীস্টান চার্চের মাধ্যমে এই পুরষ্কার দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে ব্রিটিশ অঙ্গরাজ্য ও কমনওয়েলথভুক্ত ১৫টি দেশের নাগরিকদের Knight বা Dame উপাধী দেয়া হয়। তবে মাঝে মাঝে ব্রিটিশ নাগরিক ছাড়াও কমনওয়েলথভুক্ত অন্যান্য দেশের নাগরিকদেরও এই পুরষ্কার প্রদান করা হয় তবে তাদেরকে Sir ডাকা হয় না।
ক্রিকেটে স্যার উপাধির ইতিহাস:
উপরের আলোচনায় আমরা জেনেছি যে খেলাধুলায় অনন্য কীর্তি বা অসামান্য অবদানের জন্য বৃটিশ রাজ পরিবারের মাধ্যমে খেলোয়ারদের সর্বোচ্চ সম্মান বা উপাধি দেয়া হয় যাকে নাইটহুড এ্যাওয়ার্ড বলা হয়, আর যারা এই পুরষ্কার পেয়ে থাকেন তাদেরকে "নাইট" অথবা "স্যার" বলে সম্মান জানানো হয়। ঔপনিবেশিকতার যুগে বিশেষ করে ১৯২৬ সাল থেকে বৃটিশ নাগরিক ছাড়াও কলোনাইজড বা ব্রিটিশ শাসিত দেশসমূহের ক্রিকেটাররা স্যার উপাধি পেয়ে আসছে। তবে পরবর্তীতে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়া দেশসমূহ আর এই পুরষ্কারের তালিকাভুক্ত নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতের মহারাজ কুমারকে ক্রিকেটে অনন্য অবদানের কারনে "নাইট" উপাধি দেয়া হলেও ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পর তিনি তার এই পুরষ্কার বা সম্মাননা পরিত্যাগ করেছেন।স্যার ফ্রান্সিস এডেন ল্যাসে ইতিহাসের প্রথম ব্যাক্তি যিনি ক্রিকেটে "নাইট" উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। শুধু ক্রিকেটই না; সমগ্র ক্রীড়াক্ষেত্রে এটাই ছিল প্রথম নাইটহুড পুরষ্কার। মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবে (এমসিসি) ১৮৯৮- ১৯২৬ দীর্ঘ ২৮ বছর সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সিকৃতী হিসেবে ১৯২৬ সালে তাকে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়।
ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা কেন স্যার উপাধি পায় না?
ইল্যান্ড ক্রিকেট খেলার জনক হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে এই খেলা ক্রমে ক্রমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় যুগে যুগে জন্ম নিয়েছে কিংবদন্তী অনেক ক্রিকেটার। শচীন টেন্ডুলকারকে তার অনন্য রেকর্ডের কারনে গড অফ ক্রিকেট বলা হয়! কপিল দেব, ইমরান খান বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক। জয়সুরিয়া, মুরালিধরন, ওয়াসিম আকরাম এরা সবাই কিংবদন্তী ক্রিকেটার। কিন্তু এইসব ক্রিকেটাররা স্যার উপাধি পাওযার জন্য কখনোই নির্বাচিত হয় না। যেখানে কমনওয়েলথভুক্ত দেশ অস্ট্রেলিয়ার ডন ব্র্যাডম্যান ও নিউজিল্যান্ডের রিচার্ড হাডলিকে নাইটহুড এ্যাওয়ার্ড বা স্যার উপাধি দেয়া হয়েছে সেখানে কমনওয়েলথভুক্ত দেশ ভারতের টেন্ডুলকার বা পাকিস্তানের ইমরান খানের নাম কথনোই বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এর সহজ ব্যাখা হচ্ছে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান কমনওয়েলথভুক্ত দেশ হলেও তারা এখন পুরোপুরি স্বাধীন দেশ এবং ব্রিটিশ রাজা বা রানিকে তাদের শাসক হিসেবে মেনে নেয় না। অপরদিকে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এরকম কিছু দেশ স্বাধীন হওয়া সত্বেও যুক্তরাজ্যের রাজা বা রানিকে এখনো তাদের শাষক হিসেবে সিকৃতী দেয় বা সম্মান প্রদর্শন করে। শুধুমাত্র এই কারনেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা নাইটহুড এ্যাওয়ার্ডের জন্য নির্বাচিত হয় এবং ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার ক্রিটেটাররা উপেক্ষিত থাকে।১৯২৬ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মোট ২৭ জন ক্রিকেটারকে স্যার উপাধি এবং ২ জন ক্রিকেটারকে লর্ড উপাধি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ইংল্যান্ডের ১৩ জন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৪ জন, অস্ট্রেলিয়ার ১ জন ও নিউজিল্যান্ডের ১ জন ক্রিকেটার বা ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এই সম্মাননা পেয়েছেন। উল্লেখ্য, একজন লর্ড নাইটের চেয়ে উচ্চতর পদমর্যাদা ও সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন ব্যাক্তি। তিনি সরকারিভাবে নির্বাচিত এবং পার্লামেন্ট সদস্যের চেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি!
স্যার উপাধি পাওয়া ক্রিকেটারদের তালিকা:
২। ফ্রেডরিক চার্লস টোন (১৯২৯)
৩। ফিলাম ফ্রান্সিস ওয়ার্নার (১৯৩৭)
৪। জন বেরি হবস (১৯৫৩)
৫। হেনরি গ্রেশাম (১৯৫৩)
৬। লিওনার্ড হাটন (১৯৫৬)
৭। জন ফ্রেডেরিক কার্ডাস (১৯৬৭)
৮। জর্জ ব্রাউনিং এলেন (১৯৮৬)
৯। কাউড্রে টনব্রিজ (১৯৯২)
১০। অ্যালিস ভিক্টর বেডসার (১৯৯৬)
১১। বোথাম রেভেন্সওরথ (২০০৭)
১২। এলিস্টার নাথান কুক (২০১৯)
১৩। জিওফ্রে বয়কট (২০১৯)
১৪। এন্ড্রু জন স্ট্রস (২০১৯)
এদের মধ্যে কাউড্রে টনব্রিজ এবং বোথাম রেভেন্সওরথ লর্ড উপাধি প্রাপ্ত বাকীরা সবাই স্যার উপাধি প্রাপ্ত।
২। গ্যারিফিল্ড সোবার্স (১৯৭৫)
৩। ক্লয়েড লিওপলড ওয়ালকট (১৯৯৩)
৪। এভারটন উইকস (১৯৯৫)
৫। কনরাড হান্ট (১৯৯৮)
৬। ভিভিয়ান আলেকজান্ডার রিচার্ডস (১৯৯৯)
৭। ওয়েজলি হল (২০১২)
৮। কার্টলি অ্যামব্রোস (২০১৪)
৯। রিচার্ড বেঞ্জামিন রিচার্ডসন (২০১৪)
১০। রবার্টস অ্যান্ডারসন (২০১৪)
১১। চার্লস খ্রীস্টফার গ্রিফিথ (২০১৭)
১২। ক্লাইভ লয়েড (২০২০)
১৩। গর্ডন গ্রিনিজ (২০২০)
0 মন্তব্যসমূহ