Header Ads Widget

Ticker

6/recent/ticker-posts

বাংলাদেশ ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

বাংলাদেশ ক্রিকেট

বিশ্ব ক্রীড়া মঞ্চে বাংলাদেশ নামটি প্রতিনিধিত্ব করে এর মধ্যে অন্যতম হলো ক্রিকেট খেলা। ক্রিকেটের কারণেই আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে গৌরবের সাথে বাংলাদেশের নামটি বারবার উচ্চারিত হয়। অথচ পুরো আশির দশক ও নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশজুড়ে ছিল ফুটবলের উন্মাদনা। ফুটবলকে পেছনে ফেলে কিছুদিনের মধ্যেই যে বাংলাদেশ একটি ক্রিকেট পাগল জাতিতে পরিণত হবে তা হয়তো কল্পনা করাও কঠিন ছিল। ১৯৯৭ সালে মালেশিয়ায় অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে  চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশ প্রথমবার ১৯৯৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। সেটা ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত; নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে এর পর থেকেই ক্রিকেট খেলা হয়ে যায় বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা; মানুষের আবেগ, অনুভূতি ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ! তবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস আরো পুরানো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে বাংলাদেশ ছিল ভারতীয় উপমহাদেশ ও পাকিস্তানের অংশ। ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রিকেট খেলার প্রচলন শুরু হয়েছিলো তিনশ বছর পূর্বে একদল ব্রিটিশ নাবিকের মাধ্যমে। ভারত প্রায় একশ বছর পূর্বে ১৯৩২ সালে টেস্ট ক্রিকেট খেলার মর্যাদা পায় এবং তার ২০ বছর পর ১৯৫২ সালে পাকিস্তান এশিয়ার দ্বিতীয় দেশ হিসেবে টেস্ট ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা অর্জন করে নেয়। এমন কি পাকিস্তানের প্রথম টেস্ট ম্যাচটিও অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকার স্টেডিয়ামে। তবে আলোচনার সুবিধার্থে ও লেখা ছোট করার স্বার্থে আজকে  আমরা শুধু স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুরুর ইতিহাস:

স্বাধীনতার পর একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে যখন পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করা হয় তখন দেশের ক্রিকেট উন্নয়নের কথাও চিন্তা করা হয় যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় "বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড"। ২০০৭ সালের পর থেকে যার বর্তমান নাম "বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড" (বিসিবি)। বাংলাদেশের ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিসিবি ১৯৭৭ সালে আইসিসির সহযোগী সদস্য ও ২০০০ সালে পূর্ণ সদস্য হওয়ার স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পদচারণা শুরু হয়। সেই টুর্নামেন্টে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রকিবুল হাসান। তবে আইসিসি ট্রফির ম্যাচগুলোকে আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচের স্বীকৃতি দেয়া হয় না। বাংলাদেশ তাদের প্রথম স্বীকৃত ওয়ানডে ম্যাচটি খেলে ১৯৮৬ সালের এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে। গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর নেতৃত্বে সেই ম্যাচে বাংলাদেশ মাত্র ৯৪ রানে অলআউট হয়ে যায় এবং পাকিস্তান ৭ উইকেটে জয় লাভ করে! ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ প্রথমবার এশিয়া কাপের আয়োজক দেশ হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এরপর থেকে বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে এশিয়া কাপ ও আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করতে থাকে।

১৯৯৭ সালের ঐতিহাসিক আইসিসি ট্রফি জয়:

১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের জন্য সহযোগী সদস্যদের মধ্যে থেকে তিনটি দল বাছাইয়ের উদ্দেশ্যে ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফির আয়োজন করা হয়। মালেশিয়ায় অনুষ্ঠিত সেই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ প্রথমবারের মত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। তবে বিশ্বকাপের টিকেট আগেই নিশ্চিত হয়েছিলো সেমি ফাইনালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জয় লাভের মধ্য দিয়ে। সেমি ফাইনালে খালেদ মাসুদ পাইলটের ৭০ রানের সুবাদে স্কটল্যান্ডকে ২৪৪ রানের টার্গেট দেয় বাংলাদেশ। জবাবে স্কটল্যান্ড ১৭১ রানে অলআউট হলে বাংলাদেশ ৭২ রানে জয় লাভ করে। ২৫ রানে ৪ উইকেট নিয়ে মোহম্মদ রফিক সবচেয়ে সফল বোলার। ফাইনালে বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে কেনিয়ার বিপক্ষে শেষ বলে ২ উইকেটের জয় সারা দেশকে ভাসিয়েছিল বাঁধভাঙা আনন্দ উল্লাসে! ফাইনাল ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে স্টিভ টিকালোর সেঞ্চুরিতে কেনিয়া বাংলাদেশকে ২৪১ রানের টার্গেট দেয়। মোহম্মদ রফিক সর্বোচ্চ ৩ উইকেট তুলে নেন।বৃষ্টির কারণে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে বাংলাদেশের নতুন টার্গেট দাঁড়ায় ২৫ ওভারে ১৬৬ রান। আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ৩৭, মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর ২৬, মোহাম্মদ রফিকের ২৬ ও আকরাম খানের ২২ রানের ইনিংসগুলো বাংলাদেশকে জয়ের বন্দরে পৌঁছতে সহযোগিতা করে।১৯৯৪ সালেও আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ ফেবারিট হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলো; দেশবাসীর স্বপ্ন ছিল সেবারই বাংলাদেশ ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে আরব আমিরাতের কাছে পরাজিত হয়ে সেই স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গিয়েছিল।  ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি বিজয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য একটি গৌরবময় অধ্যায়। এই টুর্নামেন্টের পর থেকেই বদলে যেতে থাকে বাংলাদেশ ক্রিকেট। বিশ্ব ক্রিকেটে  যুক্ত হয় নতুন একটি নাম! আইসিসি ট্রফি বিজয়ের পরপরই ১৯৯৭ সালের ১৫ই জুন বাংলাদেশ আইসিসি থেকে ওয়ানডে স্ট্যাটাস লাভ করে।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানো!

১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখন ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসির সপ্তম ওয়ানডে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে যায় তখন দলের কাছে প্রত্যাশা ছিল অতি সামান্য। সবার চোখে-মুখে শুধুই বিশ্বকাপের মঞ্চে প্রিয় দলকে খেলতে দেখার আনন্দ আর কিছু না। বাংলাদেশ প্রথম ও দ্বিতীয় ম্যাচে যথাক্রমে নিউজিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে পরাজিত হয়। তৃতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ আরেক নবাগত স্কটল্যান্ডকে ২২ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপে প্রথম জয়ের দেখা পায়। প্রথম ম্যাচ জয়ে দেশে আনন্দ উল্লাসের বন্যা বয়ে যায়! চতুর্থ ম্যাচে আবারও পরাজয়, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশের দেয়া ১৭৯ রানের টার্গেট শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া মাত্র ১৯.৫ ওভারেই টপকিয়ে ফেলে! পঞ্চম ও শেষ ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। ওয়াকার ইউনুস, ওয়াসিম আকরাম, সাইদ আনোয়ার, ইনজামামের মত তারকাদের নিয়ে গড়া শক্তিশালী পাকিস্তান দলের সাথে বাংলাদেশ জিতে যাবে সেটা কেউ কল্পনাও করেনি! নর্দ্যাম্পটন, কাউন্ট্রি গ্রাউন্ডে সেই অসাধ্যকেই সাধন করে বসে বাংলাদেশ! প্রথমে ব্যাট করতে নেমে আকরাম খানের ৪২ ও শাহরিয়ার হোসেনের ৩৯ রানের সুবাদে ২২৩ রান করতে সমর্থ হয় বাংলাদেশ। এই টার্গেটে জেতার স্বপ্ন কেউই দেখেনি। কিন্তু পাকিস্তান শুরুতেই ৪২ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে ফেলে। জয়টা তখন শুধু মাত্র সময়ের ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান ১৬১ রানে অলআউট হয়; বাংলাদেশ ৬২ রানে জয়লাভ করে। খালেদ মাহমুদ সুজনের ৩১/৩ সেরা বোলিং ফিগার। খেলা শেষে স্টেডিয়ামের সব দর্শক মাঠে প্রবেশ করে আনন্দ উল্লাস করতে থাকে। দেশজুড়ে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। ভোর রাত পর্যন্ত আনন্দ মিছিল চলতে থাকে। বাংলাদেশ বাংলাদেশ স্লোগানে মুখরিত হয় আকাশ-বাতাস। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের পর বাঙালি জাতি এরকম আনন্দে আর ভাসে নি!

বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তি:

বাংলাদেশ তাদের প্রথম টেস্টে প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারতকে আমন্ত্রণ জানায়। ভারত সেই আমন্ত্রণে সারা দিলে ২০০০ সালের ১০-১৩ই নভেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। নাইমুর রহমান দুর্জয়ের নেতৃত্ব সেই ম্যাচে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ১৪৫ রান এবং হাবিবুল বাশারের ৭১ রানের সুবাদে ৪০০ রান সংগ্রহ করে। জবাবে ভারত প্রথম ইনিংসে ৪২৬ রান করে। নাইমুর রহমান দুর্জয় প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেট লাভ করে। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ মাত্র ৯১ রানে অলআউট হলে ভারত ৯ উইকেটে ম্যাচ জিতে নেয়। 

বাংলাদেশকে প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ পেতে অপেক্ষা করতে হয় আরো পাঁচ বছর। ২০০৫ সালে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের সাথে প্রথম টেস্ট জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা সাফল্য:

২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে অনেক চড়াই উতরাই, সমালোচনা পার হয়ে এ পর্যন্ত আসতে হয়েছে। মাঝখানে পাঁচ বছর বাংলাদেশ দল কোন ম্যাচ জয় লাভ করতে পারে নি! একসময় বাংলাদেশ দলের টেস্ট স্ট্যাটাস বাতিল করে দেয়ার সমালোচনাও করা হয়। তবে ২০১২ সাল থেকে দল ওয়ানডে ক্রিকেটে ধারাবাহিক পারফর্মেন্স করতে থাকে।

২০১২ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে শক্তিশালী ভারত ও শ্রীলংকাকে বাদ করে দিয়ে ফাইনালে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের কাছে জমজমাট ফাইনাল ম্যাচে মাত্র ২ রানে পরাজিত হয় বাংলাদেশ। সেদিন ক্রিকেটারদের সাথে কেঁদেছিলো পুরো বাংলাদেশ। এরপর ২০১৬ এবং ২০১৮ সালের এশিয়া কাপেও ফাইনাল খেলে বাংলাদেশ। কিন্তু দুবারই ভারতের কাছে হেরে শিরোপার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়!

অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ২০১৫ সালের ওয়ানডে  বিশ্বকাপে বাংলাদেশ প্রথম বারের মত কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার গৌরব অর্জন করে। মাহমুদুল্লাহ, মুসফিক ও রুবেলের কৃতিত্বে ইংল্যান্ডের মত শক্তিশালী দলকে বাদ করে দিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে চমক দেখিয়ে দেয় বাংলাদেশ।

আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সেরা সাফল্যটা আসে ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে। কার্ডিফে সাকিব, মাহমুদুল্লাহর জোড়া সেঞ্চুরিতে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে সেমি ফাইনাল নিশ্চিত করে বাংলাদেশ দল।

সর্বশেষ ভারতে অনুষ্ঠিত ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের পারফরমেন্স ছিল হতাশাজনক। বলা যায় এটাই ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। রাউন্ড রবিন লীগ এই টুর্নামেন্টে আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কা বাদে সবগুলো দলের সাথেই বাংলাদেশ দল শোচনীয়ভাবে হেরে যায়। ছোট দল নেদারল্যান্ডের সাথেও পরাজয় বরন করতে হয়।

২০১২ সালের পর থেকে ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ ধারাবাহিক একটি দল। যে কোন দলই বাংলাদেশকে সমীহের চোখে দেখে। তবে টেস্ট আর টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখনো প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল করতে পারে নি। বিশেষ করে বিদেশের বাউন্সি উইকেটে ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতা রয়েছে।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ৪৪১ টি ওয়ানডে ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ খেলে ১৬০ টি ম্যাচে জয় পেয়েছে। আর ১৪৮ টেস্টে ২১ ম্যাচে জয় ও ১৮ ম্যাচ ড্র করতে পেরেছে। ১৭৯ টি টুয়েন্টি টুয়েন্টি ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ খেলে জয়ের সংখ্যা ৬৮।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ